
নিউজ ডেক্স
আরও খবর

চুরি হয়ে যাচ্ছে নতুন ভবনের মালামাল

সুনামগঞ্জে পুকুরে ডুবে ২ বোনের মৃত্যু

বিদেশে গেল না আম, হতাশ ব্যবসায়ীরা

টেকনাফে বিজিবির অভিযানে ১ লাখ ১০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার

প্রেমিকের খোঁজে বেরিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার তরুণী, গ্রেপ্তার ৩

পুলিশ ডেকে প্রতিবেশীকে আটকের দাবিতে আত্মহত্যার চেষ্টা, গৃহবধূ গ্রেপ্তার

কুষ্টিয়ায় কৌশলে তামাক ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন নওফেল
নজরুল-প্রমীলার কুমিল্লা নগরজুড়ে কবির স্মৃতি

জাতীয় কবি কাজী নজরুল আর কুমিল্লা যেন একসূত্রে গাঁথা। এখানে তার প্রেম-প্রণয়, বিরহ, বিচ্ছেদ, বিদ্রোহ ও সাহিত্যকর্মের অনেক সৃষ্টি-এক কথায় কবির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনার সাক্ষী এই জেলা। এই শহরের মেয়ে আশালতা সেনগুপ্ত প্রমীলার প্রেমে পড়ে কবি লিখেছেন অনেক গান-কবিতা। শেষ পর্যন্ত তাকেই তিনি জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নেন। তাই কুমিল্লাকে জাতীয় কবির জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বলা হয়। কবিপত্নী প্রমীলা নগরীর কান্দিরপাড় এলাকার বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ও গিরিবালা সেনগুপ্ত দম্পতির মেয়ে।
জানা গেছে, ১৯২১ সালের ৩ এপ্রিল নজরুল কলকাতা থেকে বন্ধু আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লায় আসেন। ওই রাতে তিনি শহরের কান্দিরপাড়ে তার সহপাঠী আরেক বন্ধু বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে ওঠেন। কয়েকদিন থাকার পর আলী আকবর খানের সঙ্গে দৌলতপুরে যান। সেখানে নার্গিসের প্রেমে পড়ে অনেক গান-কবিতা রচনা করেন। নার্গিসের সঙ্গে প্রেম ও বিয়ের ইতি টেনে তিনি ফের বন্ধু বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে ওঠেন। ওই সময় মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েছিলেন নজরুল। তখন বন্ধুর মা বিজয়া সুন্দরী দেবীসহ তাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের সহায়তায় সামলে ওঠেন তিনি। পরে বন্ধু বীরেন্দ্র সেনের চাচাতো বোন আশালতা সেনগুপ্তর সঙ্গে তার পরিচয় ও প্রেম। কবি তার নাম রাখেন প্রমীলা। তাকে নিয়ে অসংখ্য গান-কবিতা ও চিঠি লেখেন নজরুল। প্রমীলা সংস্কৃতিমনা ছিলেন। নবাব ফয়জুন্নেসা স্কুলের ছাত্রী ছিলেন তিনি। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল কলকাতার ৬নং হাজী লেনে নজরুলের সঙ্গে প্রমীলার বিয়ে হয়। যদিও নজরুলের বিয়ে তৎকালীন কুমিল্লার হিন্দু সমাজ মেনে নিতে পারেনি। সেনগুপ্ত পরিবার ও বিজয়া সুন্দরী দেবীও অখুশি হন। কিন্তু নজরুল তার বাকি জীবনটা প্রমীলার হাত ধরেই পার করেছেন।
নজরুল কুমিল্লায় থাকাকালে (১৯২১-২৩) ভিক্টোরিয়া কলেজসংলগ্ন রানীর দিঘীর পশ্চিমপাড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে প্রতিদিন কলেজ পড়ুয়া তরুণদের নিয়ে কবিতা-গানের আসর জমাতেন, আড্ডা দিতেন। বর্তমানে স্থানটিতে একটি স্মৃতিফলক রয়েছে। এখানে বসে নজরুল, ‘মাধবী লতা দোলে’সহ আরও অনেক গান ও প্রমীলার কাছে চিঠি লিখেছেন।
ধর্মসাগরের পশ্চিমপাড়ে বসে নজরুল গান ও কবিতা লিখতেন। সেই স্থানেও রয়েছে একটি স্মৃতিফলক। প্রমীলাদের বাড়ির পাশেই ছিল বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা বসন্ত কুমার মজুমদারের বাড়ি। কবির সঙ্গে পরিচয় হয় বাগিচাগাঁওয়ের বিপ্লবী অতীন রায়ের সঙ্গে। সেখানে বসন্ত স্মৃতি পাঠাগারে কবি আড্ডা দিতেন, কবিতা লিখতেন। এখানেও রয়েছে নজরুল ফলক। ইউসুফ স্কুলের পাশে অবিনাশ ময়রার দোকানের পাউরুটি ও রসগোল্লা ছিল কবির প্রিয়। কবি দারোগা বাড়ির মাজারের পার্শ্ববর্তী বাড়িতে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুর সঙ্গে অনেক গান গেয়েছেন। টাউন হল ময়দানে অনেক সমাবেশ ও জনসভায় অংশ নিয়েছেন। শহরের মুরাদপুর চৌমুহনীর জানু মিয়া সাহেবের বাড়িতে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, শচীন দেব বর্মণ ও কাজী নজরুল ইসলাম সংগীত চর্চায় অংশ নিতেন।
নজরুলপ্রেমী সাংবাদিক অশোক কুমার বড়ুয়া বলেন, কবি নজরুল আর কুমিল্লা একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবেই জড়িত। নজরুলের জীবনের প্রথম প্রেম হয় কুমিল্লায়। এখানেই তার দুই প্রিয়তমার বাড়ি।
কবি কুমিল্লায় অবস্থানকালে যেমন কবিতা-গান লিখেছেন, সংস্কৃতি চর্চা করেছেন, তেমনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করেছেন। হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে কুমিল্লার রাস্তায় ইংরেজবিরোধী গান গেয়েছেন। এ কারণে তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে।
কবির স্মৃতিকে আরও জাগরূক করে রাখতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কবি কাজী নজরুল ইসলাম হল। ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ডিগ্রি শাখায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কবি নজরুল ছাত্রাবাস। নানুয়ার দীঘির দক্ষিণ পাড়ে ‘নজরুল মেমোরিয়াল একাডেমি’। কবির অন্যতম একটি কাব্যগ্রন্থের নামে ধর্মসাগরের উত্তর পাড়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘গুলবাগিচা প্রাথমিক বিদ্যালয়।’ হাউজিং এস্টেটে নজরুল সংগীত বিদ্যালয়। বিবির বাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘জাতীয় কবি নজরুল শিশু নিকেতন’ নামের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
১৯৬২ সালে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ নজরুল স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য শহরের ফরিদা বিদ্যায়তনের সামনের সড়কটি ‘নজরুল এভিনিউ’ নামকরণ করেন। ১৯৬৯ সালে জেলা প্রশাসক কাজী আজহার আলী কুমিল্লায় নজরুল পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সংগঠনের মাধ্যমে নজরুল চর্চা শুরু হয়। ১৯৭০ সালে কুমিল্লায় সাহিত্য চর্চার মানসে গঠিত হয় ‘নজরুল ললিতা কলা পরিষদ’। যা পরে ‘নজরুল পরিষদ’ নামে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭২ সালে ‘নজরুল স্মৃতি পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৯১ কুমিল্লার জেলা প্রশাসক হেদায়েতুল ইসলাম চৌধুরী নজরুলের স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেন। ১৯৯২ সালে কুমিল্লা শিল্পকলা একাডেমির সামনে ‘চেতনায় নজরুল’ শীর্ষক একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। ২০১৩ সালে ধর্মসাগরের উত্তর পাড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র।
নজরুল গবেষক ড. আলী হোসেন চৌধুরী বলেন, কুমিল্লার গুণীজনদের সঙ্গে নজরুল সখ্য গড়ে তুলেছিলেন। কুমিল্লায় তিনি প্রেম-বিরহ, সংগ্রাম আর গ্রেফতারে হয়ে উঠেন বিদ্রোহের কবি নজরুল। তরুণ ও টগবগে সময়ে নজরুল কুমিল্লায় এসেছিলেন। তার আবেগ ও উচ্ছ্বাস এখানে বিলিয়ে দিয়েছেন।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়সার বলেন, নগরীর আনাচে-কানাচে কবি নজরুলের অনেক স্মৃতি রয়েছে। কবির সব স্মৃতি ধরে রাখার জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।