
নিউজ ডেক্স
আরও খবর

নিরন্তর টিকে থাকার লড়াই কুতুবদিয়া দ্বীপবাসীর

লুটপাটের ক্ষত মুছতে সাদা পাথরে পানি স্প্রে

বাংলাদেশের শতাধিক ওয়েবসাইটে হামলার দাবি ভারতীয় হ্যাকার গ্রুপের

ভোরে নীলা মার্কেটে হাঁসের মাংস খেতে যান আসিফ মাহমুদ, বন্ধ থাকলে যান ওয়েস্টিনে

উজানে অতিবৃষ্টি, উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলা প্লাবিত

পূজার ছুটির কারণে পেছাল টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি

৫ আগস্টের পরে অপুর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি: আসিফ মাহমুদ
খাদ্যপণ্যের মান যাচাই করেন দেশের পরমাণু বিজ্ঞানীরা

বিশ্ব যখন পরমাণু গবেষণায় অগ্রগতি দেখিয়ে এগিয়ে চলছে ভবিষ্যতের পথে, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পরমাণু বিজ্ঞানীরা ব্যস্ত খাদ্যপণ্যের মান যাচাইয়ে। যাদের প্রত্যেকের জন্য গবেষণায় বার্ষিক বরাদ্দ মাত্র ৫০ হাজার টাকা। আমদানীকৃত খাদ্যে তেজস্ক্রিয়তা আছে কি না, তা পরীক্ষায় নিয়োজিত এসব বিজ্ঞানী। অন্যদিকে, বিপরীত চিত্র কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে। গবেষণা সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা নন, বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ পান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। যাদের কেউ-ই বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট নন, সাধারণ কোনো বিষয়ের ছাত্র।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের এমন বাস্তবতায় হতাশ একাধিক গবেষক বলেন, ‘আমরা খেয়ে-পরে বেঁচে আছি, গবেষণা হচ্ছে টেবিলের কোণে কিছু সংখ্যার হিসাব রাখা পর্যন্ত।’ দেশের সাড়ে ছয়শ পরমাণু বিজ্ঞানীর মধ্যে দেড়শ জনই পিএইচডি ডিগ্রিধারী। তাদের অনেকেই পৃথিবীর বিখ্যাত গবেষণা সংস্থাগুলোয় কাজ করেছেন বা আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পেয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে তারা বর্তমানে নিয়োজিত খাদ্য পরীক্ষার কাজে, যা মূলত বন্দর ও বিমানবন্দরে আমদানীকৃত পণ্যের তেজস্ক্রিয়তা ও রেডিওআইসোটোপ শনাক্তের জন্য বাধ্যতামূলক।
যদিও সাম্প্রতিক সময়ে এই পরীক্ষাও প্রশ্নের মুখে। ব্যবসায়ী সংগঠনের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খাদ্য পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা বাতিলের চিন্তা করছে। ১৩ মে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় গত ১২ বছরের পরীক্ষার প্রতিবেদন চায়। পরে ২৬ জুন কমিশনের কাছে চাওয়া হয় গত পাঁচ বছরে কত পণ্যে তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া গেছে তার হিসাব।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বার্ষিক বাজেট প্রায় ২৫০ থেকে ২৮০ কোটি টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। অথচ এর প্রায় অর্ধেকই যায় বেতন ও ভাতা খাতে। পরমাণু শক্তি কমিশনের গত পাঁচ বছরের বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই সময়ে মোট বাজেট ছিল ১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা, যার প্রায় ৫০ শতাংশই (৪৮৬ কোটি টাকা) ব্যয় হয়েছে বেতন-ভাতায়। উল্লিখিত সময়ে গবেষণায় বরাদ্দ ছিল ২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২০-২১ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত গবেষণায় বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি টাকা করে। পরের ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিজ্ঞানীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নিয়মিত ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার পরও বিশেষভাবে ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়; কিন্তু সেই টাকাও ঠিকমতো ছাড় না করার অভিযোগ আছে।
পরমাণু শক্তি কমিশনের জন্য ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৪১ কোটি এবং গবেষণার জন্য বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছরে পুরো প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৪৮ কোটি ও গবেষণার জন্য বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৫০ কোটি ও গবেষণায় বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৭০ কোটি ও গবেষণা বাবদ বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৭৯ কোটি ও গবেষণায় বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি এবং পরবর্তী সময়ে বিশেষ বিবেচনায় গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় আরও ৯ কোটি টাকা। কিন্তু গবেষণার বাড়তি সেই টাকা ছাড়ের নামেও টালবাহানা করে মন্ত্রণালয়।
গবেষণা কিংবা কারিগরি দক্ষতা বাড়াতে প্রতি বছর কমিশনে থাকে আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণের সুযোগ। কিন্তু এসব প্রশিক্ষণে বিজ্ঞানীদের বাদ দিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার তালিকায় রয়েছেন উপসচিব মো. আশরাফুল আফসার। ২০২৪ সালের ১১ মার্চ থেকে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনবার প্রশিক্ষণের নামে ঘুরতে যান। মো. মতিউর রহমান পরপর দুবার যান প্রশিক্ষণে। মো. শহীদুল হক পাটোয়ারী ও আমিনুল ইসলাম খান গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর ও ১৪ অক্টোবর বিজ্ঞানীদের প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ভ্রমণ করেন। জাহিদুল ইসলাম, মো. ফয়সাল আবেদিন খান, প্রশান্ত কুমার দাস, সিনিয়র সহকারী সচিব ফারজানা রহমান, মো. সারোয়ার হোসেন, অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুর রাজ্জাক, মো. মঈনুল ইসলাম তিতাস, যুগ্ম সচিব বিদ্যুৎ চন্দ্র, সওগাতুল আলম ও শাহানারা ইয়াসমিন লিলির নাম রয়েছে এই তালিকায়।
গবেষণা খাতের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতি বছর একজন বিজ্ঞানীর হাতে গবেষণার জন্য বরাদ্দ পড়ে মাত্র ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এ টাকা দিয়ে না কোনো প্রকৃত গবেষণা চালানো সম্ভব, না যন্ত্রপাতি হালনাগাদ করা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ যেখানে মোট বাজেটের ১ থেকে ৩ শতাংশ গবেষণায় ব্যয় করে, সেখানে ভারত-পাকিস্তানে বরাদ্দ হয় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত। এই পার্থক্য শুধু প্রযুক্তিগত নয়, নীতিগত।
বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের উল্লেখযোগ্য গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম এবং খাদ্য পরীক্ষার মাধ্যমে প্রায় ৬২ কোটি আয় হয়েছে। অন্যদিকে দেশের গবেষণা সুবিধাদির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন চলতি অর্থবছরে ১০টি এডিপি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। বিএসসি, এমএসসি, এমফিল, পিএইচডি অর্জনের জন্য ৬১ জন গবেষককে গবেষণা তত্ত্বাবধানে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
জানা গেছে, বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা খাদ্যপণ্য পরীক্ষা করেন বিজ্ঞানীরা। তা-ও বন্ধ করতে বেশ তোড়জোড় করছে ব্যবসায়ী সংগঠনসহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। তবে আমদানি করা খাদ্যপণ্য পরীক্ষা বন্ধ হলে একদিকে যেমন দেশের শিশুসহ সব শ্রেণির মানুষ মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকবে, তেমনি দেশ বড় ধরনের কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হতে পারে।
খাদ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, রেডিয়েশন ও তেজস্ক্রিয়া, কন্টামিনেশনযুক্ত খাদ্যপণ্য আমদানি করা হলেও পরীক্ষা না করলে ধরার সুযোগ থাকবে না। এ খাদ্য সারা দেশে ছড়িয়ে গেলে তা খেয়ে মানুষ মারাত্মকভাবে অসুস্থ হবে এবং বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে নানা প্রশ্ন উঠতে পারে।
জানা গেছে, খাদ্যপণ্য আমদানি করা কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ৫ আগস্টের পর খাদ্যপণ্য পরীক্ষা বন্ধ করতে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দেয়। ব্যবসায়ীদের এই দাবির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বৈঠকে আলোচনা করে মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১২ বছরের পরীক্ষার প্রতিবেদন চেয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। এরপর গত ২৬ জুন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের কাছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এক চিঠিতে গত পাঁচ বছরে আমদানি করা খাদ্যপণ্যের পরীক্ষার সব রেকর্ড চায়। একই সঙ্গে গত পাঁচ বছরে কী পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া গেছে, সে তথ্য চাওয়া হয়েছে।
আমদানীকৃত খাদ্যপণ্যে বাধ্যতামূলক তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষার বিষয়টি বাতিলের সিদ্ধান্ত আসতে পারে, এ বিষয়টি বুঝতে পেরে এবং একটি সংবাদের প্রতিক্রিয়ায় বিবৃতি দেয় পরমাণু শক্তি কমিশন। এই বিবৃতি প্রকাশ করায় পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কেন আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, সে বিষয়ে দুই দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা চেয়ে গত ২৪ জুন চিঠি দেয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।
পরমাণু শক্তি কমিশন বিজ্ঞানী সংঘের সভাপতি ড. এ এস এম সাইফুল্লাহ বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে গবেষণার জন্য যে বাজেট দেওয়া হয়, তা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এত স্বল্প অর্থে কোনোভাবেই গবেষণা করা সম্ভব হয় না। গবেষণার জন্য সময় ও পর্যাপ্ত অর্থ দরকার।’
এই পরমাণু বিজ্ঞানী আরও বলেন, ‘খাদ্যে তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়া মানে দেশের মানুষের জন্য একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আমদানি করা খাদ্যপণ্যে প্রায়ই তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হচ্ছে। আমদানীকৃত খাদ্যপণ্য পরীক্ষা বন্ধ হলে দেশ মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকবে।’
জানতে চাইলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোকাব্বির হোসেন বলেন, ‘পরমাণু শক্তি কমিশনের বেতন-ভাতা বন্ধের বিষয়ে কখনো কোনো চিঠি ইস্যু করা হয়নি।’ তিনি উল্টো এ তথ্যের প্রতিবাদ জানান।
বর্ণমালা টেলিভিশন এর সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।