
নিউজ ডেক্স
আরও খবর

শহিদকন্যা ধর্ষণ, আলোচিত আসামি ইমরান মুন্সী গ্রেফতার

দেশে আর অশান্তি চাই না: আমির খসরু

মাদ্রাসায় বাথরুমে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেল শিক্ষার্থীর

একসঙ্গে ৬ শিশুর জন্ম দিলেন নারী

প্রায় ২ হাজার পিস ইয়াবাসহ সিদ্ধিরগঞ্জে ২ মাদক কারবারি গ্রেফতার

‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না করলে জুলাই বিপ্লব ব্যর্থ হবে’

রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি
আট মাসে ১২ হত্যাকাণ্ড ফের সন্ত্রাসের জনপদ চট্টগ্রামের রাউজান

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা আবারও সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হচ্ছে। রাজনৈতিক গ্রুপিং, আধিপত্য বিস্তার, ইট-বালুসহ বিভিন্ন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত ঘটছে খুন-খারাবি। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গত ৮ মাসে ১২টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এর মধ্যে ৮টি রাজনৈতিক এবং বাকিগুলো পারিবারিক ও স্বার্থকেন্দ্রিক। দিবালোকে যেমন প্রতিপক্ষকে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। আবার রাতের আঁধারে একপক্ষের ওপর আরেকপক্ষ ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এভাবে একের পর এক মায়ের বুক খালি হলেও প্রশাসন এসব অপরাধ থামাতে পারছে না।
জানা গেছে, উত্তর চট্টগ্রামের দুই উপজেলা রাউজান ও ফটিকছড়ি এক সময় চট্টগ্রামের সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ এলাকা ও সন্ত্রাসের জনপদ হিসাবে পরিচিত ছিল। মাঝখানে কিছুটা শান্ত থাকলেও রাউজান আবারও সেই ‘অভিধায়’ ফিরতে শুরু করেছে।
অভিযোগ উঠেছে, সাম্প্রতিক সময়ে খুন-খারাবিতে লিপ্ত হয়েছে বিএনপির দুই গ্রুপ। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দীন কাদের চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারীরা রাউজানে সংঘাত-সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। তারা এলাকায় বিভিন্ন গ্রুপ, উপ-গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। দলীয় কারণের চেয়েও বেশি সংঘাত হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থে। তবে এ নিয়ে পরস্পরকে দায়ী করেছেন গিয়াসউদ্দীন কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খোন্দকার। বুধবার চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. কর্নেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও রাউজানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়ে প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, রাউজানে খুন-খারাবি হচ্ছে এটা সত্য। আমি যোগ দিয়েছি ৩ মাস। এই ৩ মাসে তিনটি খুন হয়েছে। এর মধ্যে জাহাঙ্গীর হত্যাসহ দুটি হত্যা রহস্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে। জড়িত অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, রাউজানকে শান্ত করতে সব ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। কোনো অপরাধী বা খুনি পার পাবে না।
রাউজানে গত ৮ মাসে নিহতরা হলেন-আবদুল মান্নান মিয়া, ইউসুফ মিয়া, মাওলানা আবু তাহের, আজম খান, নুর উদ্দিন বকুল, মোহাম্মদ জাফর, জাহাঙ্গীর আলম, মোহাম্মদ হাসান, কমর উদ্দিন জিতু, মোহাম্মদ রুবেল, মানিক আবদুল্লাহ ও মোহাম্মদ ইব্রাহিম।
সূত্র জানায়, সর্বশেষ মঙ্গলবার পূর্ব রাউজানের গাজীপাড়ায় খুন হন যুবদল কর্মী ইব্রাহিম। স্থানীয় একটি বাজার থেকে ডেকে নিয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে তাকে হত্যা করে নিজ দলের প্রতিপক্ষ গ্রুপ। এর আগে গত বছরের ২৮ আগস্ট আবদুল মান্নান মিয়াকে (২৭) প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ পৌর এলাকার চৌধুরী মার্কেট সড়কের পাশের জঙ্গল ফেলে দেওয়া হয়। মান্নান রাঙামাটির কাউখালীর কবির আহাম্মদের ছেলে। তিনি বেতবুনিয়া ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি ছিলেন। এ ঘটনায় তার স্ত্রী মামলা করেছেন। ১ সেপ্টেম্বর রাউজানের সাবেক সংসদ-সদস্য ফজলে করিম চৌধুরীর বাগানবাড়ি থেকে মো. ইউসুফ মিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ইউসুফ ফজলে করিমের বাগানবাড়ির কর্মচারী ছিলেন। নিহতের ছেলে সাজ্জাদ রাউজান থানায় এজাহার দিয়েছেন।
২৯ অক্টোবর উরকিরচর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মইশকরম থেকে আজম খানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। নিহতের স্ত্রী লাকী আকতার থানায় মামলা করেছেন। নিখোঁজের ৩ দিনের মাথায় ১১ নভেম্বর শিক্ষক মাওলানা আবু তাহেরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি ওলামা লীগের সদস্য ছিলেন। নিরাপত্তার অভাবে পরিবারের সদস্যরা এ ঘটনায় কোনো মামলা করেননি। ২৪ জানুয়ারি মোটরসাইকেলে জুমার নামাজ আদায় করতে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন জাহাঙ্গীর আলম নামে এক ব্যবসায়ী। তিনি নেয়াপাড়া ইউনিয়নের আবু সৈয়দ মেম্বারের ছেলে। এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা করা হয়। পুলিশ যুবদল কর্মী মামুন, রমজান আলী, গিয়াস উদ্দিন, বিপ্লব বড়ুয়া ও নেজাম উদ্দিনকে গ্রেফতার করেছে।
১৯ ফেব্রুয়ারি যুবলীগ কর্মী মুহাম্মদ হাসানকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা না হলেও রাউজান থানার সেকেন্ড অফিসার কাউসার হামিদ হত্যা মামলা করেন। ৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ১৫ মার্চ গিয়াসউদ্দীন কাদের চৌধুরীর অনুসারীদের দেওয়া একটি ইফতার মাহফিল নিয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন কমর উদ্দিন জিতু। এর জের ধরে প্রতিপক্ষ গ্রুপ তাকে ছুরিকাঘাত ও পিটিয়ে হত্যা করে। জিতু হলদিয়া ইউনিয়নের উত্তরসর্তা গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে। এ ঘটনায় তার স্ত্রী ডেজি আকতার হত্যা মামলা করেন।
২১ মার্চ পূর্বগুজরা ইউনিয়নের হোয়ারাপাড়ায় খুন হন মোহাম্মদ রুবেল। তার বাবার নাম নুরুল আলম। তারা নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার বাসিন্দা। নিহতের ভাই মো. সোহেল জানান, তার ভাই প্রবাসী। দেশে ছুটিতে এসেছিলেন। তাকে ফোন করে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি থানায় মামলা করেছেন। এছাড়া পারিবারিক কলহের জেরে দুই ছোট ভাইয়ের হাতে খুন হন বড় ভাই প্রকৌশলী মো. নূর আলম বকুল (৪৩)। এ ঘটনায় নিহতের আরেক ভাই রাজু হত্যা মামলা করেন।
১৭ এপ্রিল রাউজান পাহাড়তলী ইউনিয়নের মাহামুনি দিঘী থেকে উদ্ধার করা হয় জাফরের লাশ। তার বাবার নাম মোহাম্মদ ইব্রাহিম। পাহাড়তলীর শেখপাড়ায় বাড়ি। তার ভাই সাইফুল ইসলাম মামলা করেছেন। ১৯ এপ্রিল রাতের খাবার খাওয়ার সময় মুখের ভেতর বন্দুকের নল ঠেকিয়ে গুলি করে এবং চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় আবদুল্লাহ মানিককে। এ ঘটনায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন তার স্ত্রী চেমন আরা বেগম।
এসব হত্যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আসামি গ্রেফতার না হওয়া প্রসঙ্গে রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, রাউজানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও হত্যা ঠেকানো যাচ্ছে না। বেশিরভাগ হত্যা পরিকল্পিত। অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধ করা যতটা সহজ হয়, হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ ততটা সহজ নয়। আমরা হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
পরস্পরকে দায়ী করলেন গিয়াস কাদের ও গোলাম আকবর : গিয়াসউদ্দীন কাদের চৌধুরী বলেন, যে ১২টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার মধ্যে ৮টিই রাজনৈতিক এবং হত্যার শিকার ব্যক্তিরা আমার অনুসারী। গোলাম আকবর খোন্দকার আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিস্ট আমলের সন্ত্রাসীদের নিয়ে আমার লোকদের হত্যা করছে। নিজে এলাকায় যেতে পারেন না অথচ বাইরে বসে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। এটা অসহনীয়। আমি রাউজানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছি।
পালটা অভিযোগ করে গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর রাউজানে যেসব খুন-খারাবি হয়েছে তার জন্য গিয়াসউদ্দীন কাদের চৌধুরী দায়ী। দলের হাইকমান্ড সুনির্দিষ্ট অভিযোগে এরই মধ্যে তাকে শোকজ করেছে। তাদের অতীত ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে তারা ৭৫ পরবর্তী এনডিপি ছিল। এনডিপি থেকে তারা সাবেক এমপি ফজলে করিম চৌধুরী জুনুসহ রাউজানকে সন্ত্রাসের জনপদ বানিয়েছে। এখন আবার ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসীদের নিয়ে নতুন করে রাউজানকে অশান্ত করছে। যারা খুন হচ্ছে তারা যেমন গিয়াস কাদেরের লোক, যারা খুন করছে তারাও গিয়াস কাদেরের লোক।