
নিউজ ডেক্স
আরও খবর

গোপালগঞ্জের ঘটনায় ফেসবুকে ‘উপহাস’, এএসপি প্রত্যাহার

প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ গাছের চারা

পাহাড়ের মাটিতে রাম্বুটান, সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

ঘরে ঢুকে ২ নারীকে কুপিয়ে হত্যা

বৃষ্টি যেন সবজিচাষিদের কান্না হয়ে ঝরছে

চুরি করতে গিয়ে পুলিশ সদস্যের স্ত্রীকে ধর্ষণ

দুম্বার সংকর প্রজাতি উদ্ভাবন করলেন মেহেরপুরের খামারি
বাংলায় ইসলাম প্রতিষ্ঠায় নাসির উদ্দীন (রহ.)’র ভূমিকা অনস্বীকার্য

সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) সিলেট বিজয়ে শাহ জালাল (রহ.)-এর অন্যতম প্রধান সেনাপতি ছিলেন। এরপর তিনি বিজয় করেন তরফ রাজ্য (বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা)। বাংলায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.)-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইমানি বলে সিলেট ও তরফ বিজয়ের পর তার সঙ্গী-সাথিরা ইসলাম প্রচারে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েন। আর এ মহান পুরুষ থেকে যান তরফের রাজধানী লস্করপুরে। এখানে থেকেই রাজ্য পরিচালনা করেছেন, ইসলাম প্রচার করেছেন। মৃত্যুর পর তাকে দাফন করা হয় তরফের অন্তর্গত হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মুরারবন্দ নামক স্থানে। তার মাজারই দেশের একমাত্র পূর্ব-পশ্চিম কবর। ১০ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এ মাজার এলাকায় শায়িত আছেন ১২০ জন অলি।
মাজারের মোতাওয়াল্লি সৈয়দ শফিক আহমদ হজে গিয়ে বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। তার ছোট ভাই মাজারের খাদেম সৈয়দ মুরাদ আহম্মদ চিশতী জানান, মাজার এলাকা নানান সমস্যায় জর্জরিত। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা কিছু স্থানে জলাবদ্ধতা। সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.)-এর ব্যবহারের কিছু নিদর্শন আছে, যেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন, যা অর্থের অভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকারি অর্থও বরাদ্দ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন সময় আমরা আবেদন করেছি। কিন্তু বলা হয়, মাজারে নাকি প্রচুর অর্থ সংগ্রহ হয়। তাই কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয় না। বাস্তবে যে অর্থ মাজারে সংগ্রহ হয়, তা কাজের জন্য খুবই অপ্রতুল। এটি কাউকেই বোঝানো যাচ্ছে না। তিনি দাবি জানান, মাজার উন্নয়নে যেন সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়। তিনি বলেন, আগে মাজার এলাকায় বিভিন্নজন আত্মীয়তার সূত্র ধরে দাফনের সুযোগ পেতেন। সেটি আবার মাজার কমিটি একটি হাদিয়া নির্ধারণ করত। তা দিয়েই তারা কবর দিতেন। এখন মাজারের জায়গা সংকুচিত হয়ে গেছে। তাই ১৫ বছর ধরে কাউকে সে সুযোগ দেওয়া হয় না। এখন কেউ এখানে কবর দিতে গেলে মাজারের বাইরে জমি কিনে সেখানে পারিবারিক কবরস্থান করছেন।
অপর খাদেম হাজী সোহেল শাহ জানান, মাজারে আসলে তেমন বড় কোনো সমস্যা নেই। ছোটখাটো কিছু সমস্যা রয়েছে। এছাড়া অনেকেই নিজ উদ্যোগেই মাজারে নানা সংস্কার কাজ করেন। মাজারে বছরে দুইবার ওরস হয়। ১৪, ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি এবং ২৩, ২৪ ও ২৫ অক্টোবর ওরসে হাজারো ভক্ত দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে আসেন।
বিভিন্ন গবেষণা পর্যালোচনা করে এবং মাজারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আলি (রা.)-এর বংশে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর দিক থেকে সৈয়দ পরিবারে আরবের বাগদাদ নগরীতে ১২৫০ খ্রি. সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.)-এর জন্ম হয়। তার বংশধররা তৎকালে বাগদাদের আব্বাসী রাজপরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা সূত্রে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিভিন্ন কারণে রাজপরিবারের সঙ্গে নিজ বংশের কলহবিবাদ বাধলে তার বংশের অনেকেই বাগদাদ ত্যাগ করে ভারতে আগমন করেন। এখানেই তারা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাদের মধ্যে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) ছিলেন। পরিবারের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর অধীনে সৈনিক বিভাগে চাকরি নেন। পরবর্তী সময়ে (১৩০৩ খ্রি.) সিপাহসালার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। একই বছর দিল্লি থেকে বাংলাদেশের সিলেট অভিমুখে (শ্রীহট্টে) রাজা গৌড় গোবিন্দের হাতে প্রতারিত মুসলমানদের সহায়তায় প্রেরিত হন। পথিমধ্যে পূর্বে প্রেরিত সিকান্দর গাজীর সঙ্গে সোনারগাঁয় ও আরব থেকে আগত প্রখ্যাত আউলিয়া শাহ জালাল (রহ.)-এর সঙ্গে ত্রিবেণীতে দেখা হয়। সেখান থেকে দিল্লির সুলতানি আদেশানুসারে শাহ জালাল (রহ.) ও সিকান্দর গাজীর সম্মতিক্রমে সেনাবাহিনীর প্রধান হয়ে সিলেট অভিযানে রওয়ানা হন। সেখানে রাজা গৌড় গোবিন্দকে পরাজিত করে সিলেট বিজয় করেন। সিলেট বিজয় সমাপ্ত করে শাহ জালাল (রহ.)-এর আদেশে বারোজন সঙ্গী দরবেশ নিয়ে ১৩০৪ খ্রি. তরফের সামন্ত ত্রিপুরা রাজা আচানক নারায়ণকে শায়েস্তা করতে তরফ রাজ্যে গমন করেন। তরফের অত্যাচারী ত্রিপুরা রাজা আউলিয়াগণের আগমনের খবর পেয়ে বিনাযুদ্ধে রাজ্য ছেড়ে ত্রিপুরার রাজাদের আশ্রয়ে চলে যান। তরফ রাজ্য সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.)-এর অধিকারে আসে। ১২ জন আউলিয়ার প্রভাবে তরফ রাজ্য বিজয় হওয়ায় এটি বারো আউলিয়ার মুলুক বলে পরিচিতি লাভ করে। পরে তরফে মুসলমানদের অধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে বারোজন আউলিয়া ইসলামের বাণী নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে গমন করে ধর্মসাধনায় নিয়োজিত হন।
সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) তরফের শাসনভার প্রাপ্ত হন। তিনি সৈন্যসহ যে স্থানে বাস করে রাজ্য পরিচালনা করেন, সে স্থান লস্করপুর নামে খ্যাত হয়। ধারণা করা হয়, ৭৪/৭৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাকে তরফ রাজ্যের অন্তর্গত চুনারুঘাট উপজেলার নরপতি গ্রামের মুরারবন্দে সমাহিত করা হয়। কথিত রয়েছে, সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) মৃত্যুর আগে তার ভক্ত-সহচরদের নসিহত করেছিলেন মৃত্যুর পর তাকে যেন পূর্ব-পশ্চিম করে দাফন করা হয়। তৎকালীন আলেম সমাজের আপত্তির মুখে ভক্ত-সহচররা তার নসিহত উপেক্ষা করে ইসলামি নিয়মানুসারে তাকে উত্তর-দক্ষিণ করেই দাফন করেন। দাফন শেষে সবাই চল্লিশ কদমের ব্যবধান পার হতে না হতেই এক প্রচণ্ড শব্দ শুনে পেছন ফিরে দেখতে পান সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.)-এর কবর ঘুরে গিয়ে পূর্ব-পশ্চিম হয়ে রয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, মুরারবন্দ যাতায়াতের দুটি রাস্তা রয়েছে। একটি ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মাধবপুর উপজেলার জগদীশপুর তেমুহনা থেকে সাতছড়ি রাস্তা ধরে চুনারুঘাট বাজার পার হয়ে শ্রীকুটা বাজার থেকে পূর্বদিকে যেতে হবে। যার দূরত্ব জগদীশপুর তেমুহনা থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার। অপরটি সিলেট থেকে শায়েস্তাগঞ্জ নতুন ব্রিজ থেকে দক্ষিণে চুনারুঘাট সড়কে রওয়ানা হয়ে শ্রীকুটা বাজারের পূর্বদিকে যেতে হবে। যার দূরত্ব নতুন ব্রিজ থেকে ৬ কিলোমিটার। মুরারবন্দ মাজার বর্তমানে দেশের অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকেই এখানে জিয়ারত করতে যান। হবিগঞ্জ জেলা শহর থেকে মাজারের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। মুরারবন্দে কয়েক শ জামগাছ রয়েছে। এখানের জাম অত্যন্ত সুস্বাদু। দেশজুড়ে এর খ্যাতিও রয়েছে। বর্তমানে তার বংশধররা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই দেশজুড়ে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। অলি-আউলিয়া ছাড়াও তার বংশে রয়েছেন মধ্যযুগের মহাকবি সৈয়দ সুলতান, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, আলেম-উলামা ও সরকারি কর্মকর্তা।
সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন